ডিজিটাল প্রযুক্তির ভিত্তি রচনায় বঙ্গবন্ধুর ভাবনা ও কৃষির উন্নয়ন
ড. মো. আমজাদ হোসেন১ ড. সমজিৎ কুমার পাল২
বঙ্গবন্ধুর আজীবনের সাধনা ছিল এদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন কৃষিনির্ভর এই বাংলাদেশে কৃষিই দেশের মানুষের মুক্তি এনে দিতে পারে। তাই কৃষির প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন তিনি। আজকের বাংলাদেশ ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে সার্বিক উন্নতির দিকে এগিয়ে চলেছে তারও সূত্রপাত করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু তাঁকে হত্যা করার মাধ্যমে তখন সেই সম্ভাবনার বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতে বাস্তবায়িত হতে চলেছে যার সার্বিক দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধুরই সুযোগ্য দৌহিত্র জনাব সজীব ওয়াজেদ জয়।
কৃষি প্রধান বাংলাদেশের কৃষিই আমাদের অর্থনীতির মূলভিত্তি। কৃষিকে ঘিরেই এদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। তাছাড়া দারিদ্র্যবিমোচন, খাদ্য নিরাপত্তা এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে কৃষির অবদানই সবচেয়ে বেশি। এদেশের বেশির ভাগ মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল। বঙ্গবন্ধু মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন এদের উন্নতি না হলে দেশের উন্নতি হবে না, স্বাধীনতার সুফল আসবে না। তাই তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ছিল কৃষিকে প্রাধান্য দেয়া। ১৯৭২ সাল থেকে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত (১৯৭৫) তাঁর কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করলেই এ কথার প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি কৃষি গবেষণাকে মনেপ্রাণে প্রাধান্য দিতেন বলেই ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত ঈশ্বরদীস্থ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট পুনর্গঠিত করে ১৯৭৩ সালেই ‘বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট’ স্থাপন করেন। ঐ বছরেই গাজীপুরে ধান গবেষণার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। ঐ সালেই রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে গঠিত হয় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল যা পরবর্তীতে জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেমের সমন্বয় সাধনের দায়িত্ব পালন করে। এ সময়ই তিনি কৃষি সংক্রান্ত অনেক নতুন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি ও বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামো ও কার্যক্রম সংস্কার ও জোরদার করার মাধ্যমে কৃষি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চর্চা এবং তার উৎকর্ষ সাধনে অনন্য অবদান রাখেন। ইক্ষু চাষ বাড়ানোর এবং চিনি শিল্পের উন্নয়নের জন্য তিনি ‘নিবিড় ইক্ষু উন্নয়ন প্রকল্প’ ও ‘খামার আধুনিকীকরণ প্রকল্প’ গ্রহণ করেন। তিনি নতুন চিনিকল স্থাপন ও বিদ্যমান কয়েকটি চিনিকলের যন্ত্রপাতি প্রতিস্থাপন ও আধুনিকায়নেরও উদ্যোগ নেন।
স্বাধীনতার পর পাট ও চিনিকল এবং টেক্সটাইল কারখানা রাষ্ট্রীয়করণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। এটি ছিল ন্যায়সঙ্গত সিদ্ধান্ত। এর প্রাথমিক ফলাফলও ছিল সত্যিই চমকপ্রদ। স্বাধীনতার প্রথম বছরের মধ্যেই দেশে পাটকলগুলো তাদের সক্ষমতার ৫৬ শতাংশ উৎপাদন করতে শুরু করেছিল।
বিশ্বে প্রথম শিল্পবিপ্লব ঘটে ১৭৬০ সালে বাষ্পীয় ইঞ্জিনের আবিষ্কারের মাধ্যমে। এরপর দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবের আবির্ভাব হয় বিদ্যুৎ উদ্ভাবনের মাধ্যমে। ইলেকট্রনিক্স আর তথ্যপ্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে শুরু হয় তৃতীয় শিল্পবিপ্লব। ১৯৬০ সালে ইন্টারনেটের আবিষ্কারের ফলে বিশ্বজুড়ে সৃষ্টি হয় নতুন প্রাণের সঞ্চার। এ সময়ই স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম। বঙ্গবন্ধু এ সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের প্রধান শক্তি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহারে উদ্যোগী হন। পাশাপাশি বাঙালিকে বিজ্ঞানমনস্ক জাতি হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। তাঁরই সার্থক শুরু ছিল আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নে (আইটিইউ) বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভ এবং বেতবুনিয়ায় ভূউপগ্রহ কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে। তাঁরই প্রচেষ্টায় ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ আইটিইউ এর সদস্যপদ পায়। এ সংস্থা স্যাটেলাইট অরবিট বা ফ্রিকোয়েন্সি সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ড করে থাকেন। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেতবুনিয়া ভূউপগ্রহ উদ্বোধন করেন যা এদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার একটি মাইলফলক। এর মধ্য দিয়েই বাংলাদেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সম্প্রসারণ এবং মহাকাশে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের ভিত্তি রচিত হয়েছিল। রচিত হয়েছিল ডিজিটাল বিপ্লবের মূল ভিত্তি। এরই ধারাবাহিকতায় মূলত ইন্টারনেট এর মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিকস, নিজে চলা গাড়ি, ত্রিমাত্রিক প্রিন্টিং, ন্যানো টেকনোলজি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, বায়োটেকনোলজি, ম্যাটেরিয়াল সায়েন্সসহ কৃষির নানাবিধ ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ করে বিশ্বে এখন বিশাল পরিবর্তন এসেছে। বৈশ্বিক অর্থনীতি হয়েছে ডিজিটাল নির্ভর । বাংলাদেশও এগিয়ে চলেছে সমান তালে।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি কৃষিতেও এর প্রয়োগ এনে দিয়েছে এক বিশাল পরিবর্তন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় কৃষি গবেষণার বিভিন্ন ক্ষেত্র, গবেষণালব্ধ নতুন জাত ও প্রযুক্তি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে দ্রুততম সময়ে পৌঁছানো, কৃষি বিপণনে এবং বাজার ব্যবস্থায় এনে দিয়েছে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন। আজ দেশের কৃষকসমাজ জানতে পারছে কৃষি আবহাওয়ার হঠাৎ পরিবর্তনের খবর, ফলে হাওড়সহ যে কোনো উপদ্রুত এলাকায় তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হচ্ছে, কোনো বিশেষ জমির জন্য উপযুক্ত সারের মাত্রা, ফসল নির্বাচন, উত্তম কৃষি চর্চা, ফসল সংগ্রহোত্তর করণীয়, বিপণনসহ নানাবিধ কার্মকাণ্ড। কৃষিতে এসব প্রযুক্তি প্রয়োগের মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে কম খরচ, দ্রুত গ্রহণযোগ্যতাসহ আরো অনেক দিক। বাংলাদেশ এখন খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশে রূপান্তরিত হয়েছে। উৎপাদিত কৃষি পণ্য সরাসরি ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে এখন ব্যাপকভাবে ডিজিটাল মাধ্যম, মোবাইল পেমেন্ট সিস্টেম প্রভৃতি ব্যবহৃত হচ্ছে। ফেসবুকের মাধ্যমেও হাজার হাজার তরুণ গড়ে তুলছেন নিজেদের কর্মসংস্থান।
বঙ্গবন্ধু যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তাঁকে হত্যার পর অর্থাৎ ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত প্রযুক্তির উন্নয়নে দেশে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ১৯৯২-৯৩ সালে বাংলাদেশকে বিনামূল্যে সাবমেরিন কেবল লাইনে অর্থাৎ সাউথ ইস্ট এশিয়া-মিডল ইস্ট-ওয়েস্ট এশিয়ায় (সিমিইউই) সংযুক্ত করার একটি সুযোগ আসে। তবে তৎকালীন সরকার তা করতে দেয়নি। ফলে পিছিয়ে যায় দেশ।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ার পর ১৯৯৮-৯৯ সালের বাজেটে তিনি কম্পিউটারের ওপর থেকে শুল্ক ও ভ্যাট সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করেন, মোবাইল ফোন সহজলভ্য করেন। ইন্টারনেট ব্যবস্থাকে সচল করেন। ঐ সময়ই দেশে প্রোগ্রামার তৈরির উদ্যোগ নেন তিনি। বাংলাদেশ থেকে সফটওয়্যার রপ্তানির উপায় উদ্ভাবনের জন্য টাস্কফোর্স গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করার উদ্যোগ নেন। কিন্তু পরে তা আবার থেমে যায়। ২০০৮ সালে দেশবাসীকে “ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখান বঙ্গবন্ধুকন্যা । ২০০৯ সালের শুরুতেই সরকার গঠন করে ঘোষণা করেন ভিশন-২০২১ ও ২০৪১। উন্নয়নকে টেকসই করতে ভিশন-২০৩১ এবং শতবর্ষব্যাপী ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ । ভিশন-২০২১ এর মূল উপজীব্য ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’। এর বাস্তবায়নে বিগত কয়েক বছরে অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই ঠিক ৪৩ বছর পর ২০১৮ সালের ১২ মে মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করে বাংলাদেশ। এর মাধ্যমে বিশ্বের ১৯৮টি দেশের মধ্যে ৫৭তম দেশ হিসেবে মহাকাশে জায়গা নিল বাংলাদেশ। দেশের স্যাটেলাইট টেলিভিশনসহ সম্প্রচার মাধ্যম এখন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট এর ব্যবহার হচ্ছে, আর সব ক’টি চ্যানেলে প্রদর্শিত হচ্ছে কৃষির কর্মকাণ্ড ।
শেষ পর্যন্ত নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন অনুযায়ী বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তর করছেন শেখ হাসিনা। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের মর্যাদা অর্জনের যে স্বপ্ন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের দেখিয়েছেন, তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এ লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। প্রযুক্তির উৎকর্ষ ও ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে সর্বোপরি ডিজিটাল মার্কেটিং এর ব্যাপারে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। দেশে এখন বিনিয়োগের উত্তম সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। হাইটেক পার্ক অত্যাধুনিক ল্যাবসহ বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে। শিক্ষিত তরুণদের মাঝে বিরাজমান বেকারত্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য দক্ষতা উন্নয়ন এবং কৃষি যান্ত্রিকীকরণে এর ব্যবহারের জন্য উদ্যোক্তা তৈরির দিকেও মনোযোগ দেয়া যেতে পারে। কৃষক ও অন্যান্য ব্যবহারকারীদের ডিজিটাল তথ্যে প্রবেশের সুযোগ, প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং দক্ষতার উন্নয়ন করা যেতে পারে। অধিক উন্নত আইসিটি যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে। যেমন: এচঝ, এওঝ, জঋওউ (জধফরড় ঋৎবয়ঁবহপু ওফবহঃরভরবৎ), জবসড়ঃব ংবহংরহম ঝসধৎঃ ফবারপব ভড়ৎ ঢ়ৎবপরংরড়হ ধমৎরপঁষঃঁৎব কৃষি তথ্যের জন্য বৃহৎ ডাটাবেজ প্রস্তুত, ব্যবস্থাপনা এবং বিশ্লেষণের সুযোগ বাড়ানো যেতে পারে। এভাবেই গড়ে উঠবে আমাদের স্বপ্নের সোনার বাংলা। আর আমরাও উচ্চকণ্ঠে উচ্চারণ করবো ‘সার্থক জনম মাগো জন্মেছি এই দেশে’।
১মহাপরিচালক ২পরিচালক (গবেষণা), বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঈশ্বরদী, পাবনা, ফোন : ০৭৩২৫৬৫৩৬২৮, ই-মেইল : dg-bsri.gov.bd